গাজায় বিমান হামলা আগেই শুরু করেছে ইসরাইল। এবার সমুদ্র এবং স্থলপথেও হামলার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে তারা। গাজা সীমান্তে ইতিমধ্যেই ১০ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। জড়ো করা হচ্ছে ট্যাঙ্কবাহিনীকেও।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী একইসাথে হামাসকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা না ছাড়লে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। গাজার উত্তর প্রান্তে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের বাস। ইসরাইলের সেই হুঁশিয়ারি পাওয়ার পরই তাদের কেউ কেউ সরে যেতে শুরু করে। তবে অনেকেই রয়ে যায় তাদের অবস্থানে। অবশ্য, শেষ কথা হলো, গাজা এখনো হামাসের নিয়ন্ত্রণে। আর সেখান থেকেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এক দিকে, বিমান হামলা চালিয়ে হামাসকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরাইল। অন্য দিকে, গাজায় ঘরে ঘরে ঢুকে হামাস সদস্যদের খুঁজে বের করে হত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কিন্তু ইসরাইল স্থলপথে হামলার কথা বললেও তাদের সামনে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞেরা। তাদের মতে, হামাসের তুলনায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে হামাসের বানানো সুড়ঙ্গের ‘জাল’।
উল্লেখ্য, গোটা গাজায় ছড়িয়ে রয়েছে সুড়ঙ্গ। যে সুড়ঙ্গপথগুলোকে ভিয়েতনামের সুড়ঙ্গপথের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। ২০ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়েও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি আমেরিকা। কারণ আমেরিকার সেনাবাহিনী এই সুড়ঙ্গপথ পার করে ঢুকতে পারেনি। হামাসও সে রকমই গোটা গাজায় সুড়ঙ্গের জাল বিছিয়ে রেখেছে, যা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে।
২০২১ সালে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) দাবি করেছিল, ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি হামাসের তৈরি সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। কিন্তু হামাস নেতা ইয়াহা সিনওয়ার পরবর্তীকালে দাবি করেন, গাজায় ৫০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গপথ রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কয়েকটি রিপোর্টের দাবি, এই সুড়ঙ্গ গোলকধাঁধার মতো। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ তার সন্ধান পাওয়া মুশকিল।
বেশ কয়েকটি রিপোর্টে এমনও দাবি করা হয়েছে, কোথাও কোথাও সুড়ঙ্গপথ শুরু হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের ঘর থেকে। সেই সুড়ঙ্গ নাকি সীমান্ত পেরিয়ে এক দিকে মিসর এবং অন্য দিকে ইসরাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই কারণেই ইসরাইলি সেনা হামাসের এই সুড়ঙ্গ জালকে ‘গাজা মেট্রো’ও বলে থাকে। এই সুড়ঙ্গকে নিরাপদ আশ্রয় এবং অস্ত্র মজুতের ঠিকানা হিসাবেও ব্যবহার করে হামাস বাহিনী।
গত ৭ অক্টোবর রকেট হামলার পাশাপাশি গাজা সীমান্ত সংলগ্ন ইসরাইলের শহরে হামলা চালাতে এই সুড়ঙ্গপথকে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে দাবি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর। গাজা সীমান্ত দিয়ে বাইরের কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য অত্যাধুনিক সেন্সর লাগিয়ে রেখেছে ইসরাল। কিন্তু সুড়ঙ্গপথ ব্যবহার করে ইসরাইলের মাটিতে হামাস বাহিনী ঢোকার কারণে সেই সেন্সর হামাস সদস্যদের গতিবিধি ধরতে পারেনি বলেই মনে করা হচ্ছে।
রিচম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফনে রিচমন্ড বরাক বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হামাসের বানানো সুড়ঙ্গে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে। হামলা থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য ওই সুড়ঙ্গে আশ্রয় নেয় তারা। সুড়ঙ্গগুলোতে ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ সেন্টার রয়েছে। বেশির ভাগ সুড়ঙ্গ ১ মিটার চওড়া এবং আড়াই মিটার উঁচু।’
স্থলপথে হামলা চালানোর জন্য ইসরালও যেমন প্রস্তুতি নিচ্ছে, হামাসও এই হামলা রুখতে তৎপর হয়ে উঠেছে। দুই বাহিনীর কাছে কোন কোন অস্ত্র রয়েছে, সেই অস্ত্র কতটা ঘাতক তা জেনে নেয়া যাক। হামাস শুরু থেকেই রকেট হামলা চালাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে অস্ত্র বানানোর কাজও করছে তারা। ৭ অক্টোবর ২০ মিনিটের মধ্যে যে ৫,০০০ হাজার রকেট হামলা চালানো হয়েছিল ইসরাইলে, ঘটনাচক্রে, সেই রকেট নাকি বানানো হয়েছিল ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে।
হামাস সাধারণত ইরানের তৈরি ফতেহ-১১০ রকেট ব্যবহার করে। ৫০০ কেজির ওজন এই রকেট ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত হামলা চালাতে সক্ষম। এ ছাড়াও আল কুদস নামে এক ধরনের রকেটও ব্যবহার করে হামাস। সেটি নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি। গোটা ইজ়রায়েল সেই রকেটের আওতার মধ্যে রয়েছে। এই দুই রকেট ছাড়াও হামাসের হাতে রয়েছে এম-৩০২ রকেট। যেটি সিরিয়ার তৈরি।
হামাসের হাতে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কনট ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৯৮ সাল থেকে বহু দেশের সেনাবাহিনী এই অস্ত্রের ব্যবহার করছে। এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার ইউনিট বানানো হয়েছে এই অস্ত্র। এক একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন ২৭-৬৪ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। দৈর্ঘ্যে ১২০০ মিলিমিটার। কনটের পাল্লা ১০০ মিটার থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার। কনট-ইএম পৌঁছতে পারে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে।
ইসরাইল সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে মেরকাবা ট্যাঙ্ক। এর চারটি রূপ রয়েছে ইসরাইলের কাছে। ৬৫ টনের এই ট্যাঙ্কে চারজন ক্রু মেম্বার এবং ছয়জন সেনাসদস্য থাকেন। এই ট্যাঙ্কে রয়েছে ১২০ মিলিমিটার স্মুথবোর বন্দুক। এ ছাড়াও এটি অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র লাহাত-ও উৎক্ষেপণ করতে পারে। এ ছাড়াও এই ট্যাঙ্কে রয়েছে ১২.৭ মিলিমিটারের একটি মেশিন গান, ৭.৬২ মিলিমিটারের আরও তিনটি মেশিন গান, একটি মর্টার লঞ্চার, একটি ইন্টারনাল মর্টার লঞ্চার এবং ১২টি স্মোক গ্রেনেড লঞ্চার।
হামাসের কাছে রয়েছে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কংকার্স। ১৯৭০ সালে এই অস্ত্র বানানো হয়েছিল। এক একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন ১৪.৬ কেজি। লঞ্চিং প্যাডের ওজন ২২.৫ কেজি। ক্ষেপণাস্ত্রের দৈর্ঘ্য ৪৫ ইঞ্চি। তার মধ্যে ২.৭ কেজি হিট ওয়ারহেড লাগানো। ৭০ মিটার থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত হামলা চালাতে পারে। ২০৮ মিটার প্রতি সেকেন্ড গতিতে ছোটে এই ক্ষেপণাস্ত্র।
ইসরাইলের কাছে রয়েছে ইডন আর্মড ভেহিকল। এই সামরিক বাহনটি যুদ্ধে বেশ সফল। ৩০-৩৫ টন ওজন। এই বাহনে কমান্ডার, চালক এবং আরসিডব্লিউএস ছাড়া ৯ জন সেনাসদস্য বসতে পারেন। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে এই সামরিক যান। ৩০-৪০ মিলিমিটার বন্দুক, ২টি স্পাইক ক্ষেপণাস্ত্র থাকে এই বাহনে। এমন ভাবে এই বাহন তৈরি করা হয়েছে যাতে বিস্ফোরণ এবং বন্দুকের গুলিতেও প্রভাব পড়ে না।
হামাসের কাছে রয়েছে ৯কে১১১ ফোগোট ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এটি সেমি-অটোমেটিক কমান্ড টু লাইন অফ সাইট (এসএসিএলওএস) ওয়ার গাইডেড ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এক একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন সাড়ে ১২ কেজি। দৈর্ঘ্যে ৩.৭ ফুট। ঘণ্টায় ২৯০ কিলোমিটার বেগে ছোটে এই ক্ষেপণাস্ত্র। যেতে পারে ৭০-২৫০০ মিটার পর্যন্ত।
ইসরাইলের কাছে রয়েছে নামের আর্মড ভেহিকল। যার অর্থ চিতাবাঘ। এই সামরিক যানে ১৭.৭ মিলিমিটার মেশিনগান, এমকে ১৯ গ্রেনেড লঞ্চার রয়েছে। এ ছাড়াও একটি এফএন ম্যাগ মেশিনগান, মর্টার লঞ্চার, ১২টি স্মোক গ্রেনেড আছে। এর রেঞ্জ ৫০০ কিলোমিটার।
এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, হামাসের কাছে অন্তত ১০ হাজার যোদ্ধা রয়েছেন। গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ এই যোদ্ধারা। গাজা তাদের মূল কেন্দ্র। অন্য দিকে, ইসরাইলের কাছে রয়েছে প্যারাট্রুপার, কমান্ডো বাহিনী। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এই বাহিনী যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এ ছাড়াও ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সে বেশ কিছু স্পেশাল ইউনিট রয়েছে। সেগুলো হল কমান্ডো ইউনিট ১০১, সায়েরেট, ১৩ ফ্লোটিলা, ইউনিট ৫১০১, ওজেড ব্রিগেড, গোলানি, জিবাতি, নাহল, কফিরের মতো ঘাতক বাহিনী।
সূত্র : আলজাজিরা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং অন্যান্য